ঢাকা ১০:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
জাতীয়তাবাদী যুবদলের গৃহদাহ চিত্রনায়িকা পলির বিরুদ্ধে জিডি করলেন প্রযোজক জেনিফার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন না সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপিপন্থী নেতারা পণ্য বয়কটের ঘোষণা দিলেও ভারতীয় কূটনৈতিকদের সাথে ইফতার বিএনপি’র আইএসআইকে সন্তুষ্ট করতে ভারতবিরোধিতা করছে বিএনপি : নানক মহাসচিব পদ থেকে মির্জা ফখরুলের বিদায়ের সুর বিএনপির ভারত বিরোধিতা সস্তা ইস্যু: নানক বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসক ধর্মঘট, ভোগান্তিতে রোগীরা কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনঃ সভাপতি রাফি, সম্পাদক পিয়াস বিএনপি নির্বাচন বানচালে সফল হলে দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান হতোঃ তথ্য প্রতিমন্ত্রী
বিজ্ঞপ্তি ::
আমাদের নিউজপোর্টালে আপনাকে স্বাগতম... সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে...

প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি বিবাহবিচ্ছেদ, আবেদনকারীদের ৭০% নারী

ডেস্ক রিপোর্ট
  • আপডেট সময় : ১১:৫৬:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৩ ৭৫ বার পড়া হয়েছে

জুন ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে, আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশ নারী। বিবাহবিচ্ছেদের এই হার জনমনে তৈরি করেছে উদ্বেগ। আমাদের দেশে গ্রে ডিভোর্সের হার কম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক তারকা দম্পতি কিংবা সুপরিচিত ব্যক্তির বিবাহবিচ্ছেদের খবর পত্রিকার পাতায় জায়গা পায়; অলক্ষ্যে রয়ে যায় নাম না জানা অনেক দম্পতির দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদের গল্প।

আগস্ট’২৩-এ সিএনএনে ‘মোর বেবি বুম্বারস আর লিভিং অ্যালোন, ওয়ান রিজন হোয়াই: গ্রে ডিভোর্স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের বিবাহবিচ্ছেদ, যা গ্রে ডিভোর্স নামে পরিচিত, আগের তুলনায় বেড়েছে ৩ গুণ, ফলে বাড়ছে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা। ২০২২ সালে প্রায় ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী আমেরিকান নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ মিলিয়ন, যা আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং বিবাহ সম্পর্কে নতুন চিন্তা এই বিচ্ছেদের মূল কারণ (সূত্র: সিএনএন, ৩ আগস্ট ২০২৩)। স্বয়ং মার্কিনরা নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষের হার বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বায়নের এই যুগে খুব সহজেই ধারণা করা যায়, সম্পর্কের ভিত মজবুত না হলে লোকদেখানো সম্পর্ক খুব বেশি দিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ফলে নারীর ওপর সংসার ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বের চাপ কমাতে না পারলে বর্তমানে ঢাকা শহরে ৪০ মিনিটে ১টি বিচ্ছেদের যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তা ১০-১৫ বছর পর হয়তো আরও বাড়বে। অনুমান করা যায়, বাড়বে পঞ্চাশোর্ধ্ব নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা।

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা মানুষের মৌলিক চাহিদা। আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর যৌন চাহিদা পরিপূরণের বৈধ সামাজিক লাইসেন্স হলো বিয়ে। বিয়ের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী যেমন একদিকে তাঁদের সহজাত জৈবিক চাহিদা বৈধভাবে পরিপূরণ করতে পারেন, তেমনি নর-নারীর বহুগামিতা প্রতিরোধেও বিয়ের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও এটি সত্যি যে আমাদের সমাজ একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর বা নারীর এই স্বাভাবিক চাহিদাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করে বরং এই স্বাভাবিক যৌন চাহিদাকে বোতলবন্দী করে রাখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্রতি উভয়ের যৌন চাহিদা পূরণের আবশ্যকতাকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এ কারণে একটা পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁদের সম্পর্ক হয়ে ওঠে কেবল সন্তানকেন্দ্রিক এবং পারস্পরিক আকর্ষণহীন।

বিবাহ একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দুজন নর-নারী দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে। কখনও পারিবারিক সম্মতিতে আবার কখনও নিজেদের পছন্দে। দেশ-কাল-পাত্র ও ধর্ম-বর্ণভেদে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা এবং আনুষাঙ্গিকতা অনেকটা ভিন্ন হয়।
সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে বিবাহ হয় ইসলাম ধর্মে, যা অনেকটা এমন- ‘উঠ ছুড়ি, তোর বিবাহ লেগেছে, বরকনে পছন্দ হলো, কাজি ডাকো, নাম ঠিকানা বলো, কেউ একজন জিজ্ঞেস করো রাজি? বলো কবুল! হলো বিবাহ। পরে কাজি অফিসে গিয়ে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, যা বাধ্যতামূলক। আবার তালাকের বেলায় সিটি করপোরেশনে নোটিশ, ৯০ দিন অপেক্ষা, তালাক কার্যকর। তালাক রেজিস্ট্রেশনও বাধ্যতামূলক।

হিন্দু ধর্মে স্থান, প্রথা ও আচারগত ভিন্নতা আছে। ছাদনাতলায় সাতপাকে বাঁধা, অগ্নিসাক্ষী, মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ। বিচ্ছেদ নেই। তবে ভারতে কারণ দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে।
বৌদ্ধ ধর্মে এলাকা ও রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকলেও বিবাহ মন্দিরে কিংবা অন্যকোথাও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ হওয়ার প্রথা চালু আছে। বিচ্ছেদের বেলায় বিবাহের কারণ দেখিয়ে কোর্ট থেকে তালাক হয়।

সবচেয়ে সুন্দর রীতি খ্রিস্টান ধর্মীয় বিবাহের অনুষ্ঠানে। তাদের বিবাহ সাধারণত চার্চে অনুষ্ঠিত হয়। আগে থেকেই বরকন্যার ঠিকানা জানিয়ে নোটিশ দেয়া হয়। কারো কোনো মন্তব্য বা আপত্তি থাকলে জানাতে বলা হয়। পরে চার্চে বিবাহর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। দুজনের কল্যাণে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। আর বিবাহবিচ্ছেদ করা যায় আদালতে ডিক্রির মাধ্যমে।

অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্র ‘আ সেপারেশন’–এর শেষ দৃশ্যটি স্মরণ করা যাক। মা–বাবার বিচ্ছেদ মামলা পারিবারিক আদালতে গড়িয়েছে। শুনানি শেষ। দম্পতির কিশোরী কন্যাকে ডাকলেন বিচারক। বাইরে অপেক্ষমান বিচ্ছেদের রায়-প্রত্যাশী দম্পতির প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো যেন আর কাটে না। ভেতরে বিচারক কন্যাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তার কিছু বলার আছে কি না। কন্যাটির উত্তর—‘আমাকে কি বলতেই হবে?

ছবিটির এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু দর্শকের কানে সিনেমার শেষ মুহূর্তটির শেষ সংলাপ ‘আমাকে কি বলতেই হবে?’ একটি দম আটকে দেওয়া অনুভুতির জন্ম দিতে পারে। কারণ, কিশোরীটির একটি উত্তরের পেছনে অসংখ্য উত্তর আছে। ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘জানি না’, ‘আমার কিছু আসে যায় না’, ‘তাদের সম্পর্ক তারাই বুঝবে’, ‘আমি কী করতে পারি? আমার দায় কেন হবে, ‘আমার কারণেই তাঁরা অসুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন, এ রকম খোঁটা এবং দায় আমি নিতে যাব কেন’, ‘তাঁরা নিজেদের সম্পর্কের দেখভালেই ব্যর্থ, আমার দেখভালে সফল কীভাবে হবেন?’—এ রকম অসংখ্য সম্ভাব্য উত্তরও হতে পারে।

বিবাহ জীবনের জন্য নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ একত্রে বৈধভাবে স্বামী-স্ত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। সবাই চায় বিবাহিত জীবন সুখের হোক, দুজন মিলে স্বাচ্ছ্যন্দে জীবন কাটাতে সফল হোক।
বিধিবাম হলে বিবাহের পর নারী-পুরুষ যেমন সংসার শুরু করে, তেমনি অনেক সময় দেখা যায় বিচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি বেজে গেছে।

কেন বিচ্ছেদ, কেনইবা সংসার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না?

আইনজীবী জাহানারা পারভীন-এর  দীর্ঘ ২৫ বছর আইনীসেবা দিতে গিয়ে তার দেখা কিছু কারণ তুলে ধরেন অভিজ্ঞতার আলোকে- তার মতে,

আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ধৈর্যহীনতা, সহনশীলতার ঘটতি, ভার্চ্যুয়াল জগতের প্রভাবে বহুকামীতাই পারিবারিক সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে উঠার অন্যতম কারণের একটি।

তালাকের মূল কারণ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হলে নিন্মের কারণ গুলো শতকরা ৯৮%।

তার মতে তালাকের প্রধান তিনটা কারণ:

★ শারীরিক অক্ষমতা

★ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পর্ণগ্রাফি, পরকীয়া, বহুকামীতা

★ মাদকাসক্তি / ড্রাপ এবইউজ ( প্রয়োজনের ব্যতীরেকে অথবা মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ সেবক)

এছাড়াও…..

স্বামী বা স্ত্রী dominating character এর হলে

পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও একে অন্যের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকা

সবচেয়ে মূল সমস্যা টাকাপয়সা নিয়ে। স্ত্রীরা চাকুরী করলে টাকা পয়সার হিসেবে স্বামী চাইতে পারবে না কিন্তু স্বামীর টাকা পয়সার হিসেবে স্ত্রী আনায় আনায় হিসেবে নেয়।

স্বামী বা স্ত্রীর আত্নীয় স্বজন যখন স্বামী স্ত্রীর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তখন ফলাফল একটা (ডিভোর্স) করেই ছাড়েন।

শারীরিক অক্ষমতা

শারীরিক অক্ষমতা, যৌনব্যাধি আর যৌনবিকারগ্রস্ত সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ। এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়। বিবাহ-বন্ধনের অন্যতম বিষয় হলো- স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য মিলন। প্রকারান্তরে সন্তান গ্রহণ। সমাজে প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বাবা-মা তাদের সন্তান যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষম জানা সত্ত্বেও সন্তানকে বিবাহের আসরে বসিয়ে দেন। বাসর রাতেই অক্ষম স্বামীর হিংস্রতার শিকার হয় মেয়েটি। কখনও পরিবারকে এই লজ্জাজনক কথাটি জানাতে বাধ্য হয়, কখনওবা গোপনে চিকিৎসা চালিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।

যৌতুক

যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে বর বা কনে যেকোনো পক্ষের কাছে যৌতুক দাবি অপরাধ হিসেবে গণ্য। যৌতুকের জন্য স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় নারী। কখনও যৌতুকের বলি হয়ে মৃত্যুবরণও করার দৃষ্টান্ত সমাজে কম নয়। যৌতুক দাবি কিংবা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে।

বাল্যবিবাহ
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছরের কম বয়সের বিবাহকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। সম্প্রতি করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ভয়াবহ হারে। স্কুল বন্ধ, বাবা-মা ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েকে বিবাহ দিয়েছে অনেকটা ঝঞ্ঝামুক্ত হওয়ার জন্য। ছোট ছেলেমেয়েরা অনেকে নিজে পছন্দ করে পালিয়ে গিয়েও বিবাহ করে ফেলে। নাবালিকা কন্যা বিবাহের পর তার লালিত স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যখন মিল খুঁজে পায় না, যখন তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভেঙে যায়; তখনই বেছে নেয় বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত।

বহুবিবাহ
একজন নারী তার স্বামীকে একা পেতে চায়। স্বামীর ভাগ কোনোভাবেই কাউকে দিতে চায় না। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী গোপনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। সংসারের প্রতি স্বামীর দায়িত্বহীনতা আর উদাসীনতা নারীটিকে কাঁদায়। সংসার-সন্তান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় স্বামীর বহুবিবাহ মেনে নেয়া অনেক স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে নেয় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।

পরকীয়া

বর্তমানে যুগের একটি খারাপ দিক হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক-স্থাপন। ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় সবাই অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে নতুন সঙ্গী। ফলে পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে অনেক নারী-পুরুষ। গড়ে তুলছে এক্সট্রা-ম্যারিটাল সম্পর্ক। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। অন্যপুরুষ বা নারীতে আসক্ত পরিবারে অশান্তি-অবিশ্বাস ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা৷ একসময় উভয়পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

মাদকাসক্তি
যার স্বামী-সন্তান, স্ত্রী বা পরিজন মাদকাসক্ত সে জানে মাদকের ভয়াবহতা। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আসা অধিকাংশের কাছ থেকে জানা যায়, মাদকাসক্ত কোনো ব্যক্তি আর মানুষ থাকে না। অমানুষে পরিণত হয়। নারী বা পুরুষ হয়ে যায় হিংস্র। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে প্রকট হয়ে ওঠে দাম্পত্য জীবনে।
দেশের প্রচলিত আইনে শারীরিক নির্যাতন অপরাধ। এর শাস্তির বিধান আছে কিন্তু মানসিক নির্যাতনের কোনো শাস্তি নেই। সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেলে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় ক্ষতিগ্রস্ত নারী। এছাড়া স্বনির্ভর ও আত্মসচেতন নারীরা এখন আর বাইরে কাজ করে এসে পারিবারিক নির্যাতন বা সহিংসতা মেনে নেয় না। ফলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

বিপথগামী স্বামী-স্ত্রী ও বহুগামিতা

স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে সন্দেহ করা একটি মানসিক ব্যাধি। সন্দেহ যখন বাস্তবতায় রূপ নেয়, তখন অসুস্থ আবহাওয়ায় না থেকে বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। বহুগামী নারী-পুরুষ আর মানুষের চরিত্র ধারণ করতে পারে না। সুতরাং পঙ্কিলতা থেকে বেরিয়ে বিবাহবিচ্ছেদকে সঠিক পথ ভেবে বিচ্ছেদ বেছে নেয় ভুক্তভোগী।

অনধিকারচর্চার প্রবেশ

অনেক পরিবারে দেখা যায় বিবাহের পর পরিবারের অনেকে দম্পতির ব্যাপারে অনধিকারচর্চা করে। আত্মীয়স্বজন বা মুরব্বিদের কেউ কেউ নিজেদের মতো দম্পতির সংসার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এতে একসময় তিক্ততা চলে আসে, যা বিবাহবিচ্ছেদের পথ খুলে দিতে পারে।

ধৈর্যহীনতা

আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা একেবারেই ধৈর্যহীন। সামান্য বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তারা সংসার নির্বাহ করতে চায় না। হুট করে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সব কিছুতে থোড়াই কেয়ার। সহ্য করার ক্ষমতা নেই বলে সামান্য কারণে ছেলেমেয়েরা বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়। বিবেক, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না।

বর্তমানে সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন পড়ে। এ সংবাদ পরিবার-সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য সুখকর হতে পারে না।
অনেকেই আইনবিধি ও নিয়মকানুনের ধারেকাছে না গিয়ে নোটিশ গোপন করে ৯০ দিন পর বিচ্ছেদের ঘোষণা দিচ্ছে। স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে অবস্থান করছে; বিদেশে তালাক ঘটানো ব্যয়বহুল তাই দেখা যায়, এক ফাঁকে দেশে এসে গোপনে তালাক দিয়ে একজন আরেকজনকে প্রতারিত করছে। অনেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এমনকি নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে বে-আইনি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে তালাক প্রদান করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাক দুটোরই ডিজিটালাইজেশন জরুরি। বিবাহ হলে অনলাইন যেমন জানতে পারবে, বিচ্ছেদ হলেও অনলাইনে বিষয়টি অবহিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আর তালাক রেজিস্ট্রেশন অনলাইন হওয়া সময়ের দাবি। এতে করে প্রতারিত হওয়ার মাত্রা কমে যাবে। যা নারী-পুরুষ দুপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর।

তবে দিন দিন কেন এত বিবাহবিচ্ছেদ? তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিকতার পতন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপের পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জায়গা আজ ঠুনকো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।

ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবালের মতে, বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে চলার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ‘সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগরজীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া ইত্যাদি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’

মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়াই একমাত্র কৌশল, একেই বলে পারষ্পরিক সৌহার্দ্য শ্রদ্ধাবোধ। যার প্রবণতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষমার সদিচ্ছা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় চোখধাঁধানো কৃত্রিম সম্পর্ক দেখে নিজের বাস্তব জীবনে তা খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাও বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল ধরার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
সব মুদ্রারই যেমন দু’টি পিঠ আছে, তেমনি সব জিনিসেরই ভাল-খারাপ দু’টি দিক আছে। কিছু মানুষ অনেক সময় তালাকের অপব্যবহার করে। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের অপরাধে তালাক দেওয়া যায় এবং তার পদ্ধতিগত ধাপগুলি ঠিকঠাক মানা হলো কি-না সেটা চিন্তা ভাবনা করে না। সর্বোপরি দেখা দরকার পারস্পরিক সংশোধন ও সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সুযোগ দেওয়া হলো কি-না। এসব কিছু না ভেবে নিছক হঠকারিতা কিংবা বহুবিবাহের লিপ্সা থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বিবাহবিচ্ছেদের সহজলভ্য ছাড়পত্র বানানো কোন ধর্মই সমর্থন করে না।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি বিবাহবিচ্ছেদ, আবেদনকারীদের ৭০% নারী

আপডেট সময় : ১১:৫৬:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৩

জুন ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ছে, আবেদনকারীদের ৭০ শতাংশ নারী। বিবাহবিচ্ছেদের এই হার জনমনে তৈরি করেছে উদ্বেগ। আমাদের দেশে গ্রে ডিভোর্সের হার কম হলেও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক তারকা দম্পতি কিংবা সুপরিচিত ব্যক্তির বিবাহবিচ্ছেদের খবর পত্রিকার পাতায় জায়গা পায়; অলক্ষ্যে রয়ে যায় নাম না জানা অনেক দম্পতির দীর্ঘদিনের বৈবাহিক সম্পর্কের বিচ্ছেদের গল্প।

আগস্ট’২৩-এ সিএনএনে ‘মোর বেবি বুম্বারস আর লিভিং অ্যালোন, ওয়ান রিজন হোয়াই: গ্রে ডিভোর্স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের বিবাহবিচ্ছেদ, যা গ্রে ডিভোর্স নামে পরিচিত, আগের তুলনায় বেড়েছে ৩ গুণ, ফলে বাড়ছে নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা। ২০২২ সালে প্রায় ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী আমেরিকান নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ মিলিয়ন, যা আগের তুলনায় তিন গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা এবং বিবাহ সম্পর্কে নতুন চিন্তা এই বিচ্ছেদের মূল কারণ (সূত্র: সিএনএন, ৩ আগস্ট ২০২৩)। স্বয়ং মার্কিনরা নিঃসঙ্গ বয়স্ক মানুষের হার বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিশ্বায়নের এই যুগে খুব সহজেই ধারণা করা যায়, সম্পর্কের ভিত মজবুত না হলে লোকদেখানো সম্পর্ক খুব বেশি দিন টিকিয়ে রাখা মুশকিল। ফলে নারীর ওপর সংসার ও সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বের চাপ কমাতে না পারলে বর্তমানে ঢাকা শহরে ৪০ মিনিটে ১টি বিচ্ছেদের যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে, তা ১০-১৫ বছর পর হয়তো আরও বাড়বে। অনুমান করা যায়, বাড়বে পঞ্চাশোর্ধ্ব নিঃসঙ্গ মানুষের সংখ্যা।

দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা মানুষের মৌলিক চাহিদা। আর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর যৌন চাহিদা পরিপূরণের বৈধ সামাজিক লাইসেন্স হলো বিয়ে। বিয়ের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী যেমন একদিকে তাঁদের সহজাত জৈবিক চাহিদা বৈধভাবে পরিপূরণ করতে পারেন, তেমনি নর-নারীর বহুগামিতা প্রতিরোধেও বিয়ের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা আছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও এটি সত্যি যে আমাদের সমাজ একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর বা নারীর এই স্বাভাবিক চাহিদাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করে বরং এই স্বাভাবিক যৌন চাহিদাকে বোতলবন্দী করে রাখেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের প্রতি উভয়ের যৌন চাহিদা পূরণের আবশ্যকতাকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এ কারণে একটা পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁদের সম্পর্ক হয়ে ওঠে কেবল সন্তানকেন্দ্রিক এবং পারস্পরিক আকর্ষণহীন।

বিবাহ একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে দুজন নর-নারী দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে। কখনও পারিবারিক সম্মতিতে আবার কখনও নিজেদের পছন্দে। দেশ-কাল-পাত্র ও ধর্ম-বর্ণভেদে বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা এবং আনুষাঙ্গিকতা অনেকটা ভিন্ন হয়।
সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে বিবাহ হয় ইসলাম ধর্মে, যা অনেকটা এমন- ‘উঠ ছুড়ি, তোর বিবাহ লেগেছে, বরকনে পছন্দ হলো, কাজি ডাকো, নাম ঠিকানা বলো, কেউ একজন জিজ্ঞেস করো রাজি? বলো কবুল! হলো বিবাহ। পরে কাজি অফিসে গিয়ে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন, যা বাধ্যতামূলক। আবার তালাকের বেলায় সিটি করপোরেশনে নোটিশ, ৯০ দিন অপেক্ষা, তালাক কার্যকর। তালাক রেজিস্ট্রেশনও বাধ্যতামূলক।

হিন্দু ধর্মে স্থান, প্রথা ও আচারগত ভিন্নতা আছে। ছাদনাতলায় সাতপাকে বাঁধা, অগ্নিসাক্ষী, মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ। বিচ্ছেদ নেই। তবে ভারতে কারণ দেখিয়ে অনুমতি নিয়ে বিচ্ছেদ হচ্ছে।
বৌদ্ধ ধর্মে এলাকা ও রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকলেও বিবাহ মন্দিরে কিংবা অন্যকোথাও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাধ্যমে মন্ত্রপাঠ করে বিবাহ হওয়ার প্রথা চালু আছে। বিচ্ছেদের বেলায় বিবাহের কারণ দেখিয়ে কোর্ট থেকে তালাক হয়।

সবচেয়ে সুন্দর রীতি খ্রিস্টান ধর্মীয় বিবাহের অনুষ্ঠানে। তাদের বিবাহ সাধারণত চার্চে অনুষ্ঠিত হয়। আগে থেকেই বরকন্যার ঠিকানা জানিয়ে নোটিশ দেয়া হয়। কারো কোনো মন্তব্য বা আপত্তি থাকলে জানাতে বলা হয়। পরে চার্চে বিবাহর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। দুজনের কল্যাণে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। আর বিবাহবিচ্ছেদ করা যায় আদালতে ডিক্রির মাধ্যমে।

অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্র ‘আ সেপারেশন’–এর শেষ দৃশ্যটি স্মরণ করা যাক। মা–বাবার বিচ্ছেদ মামলা পারিবারিক আদালতে গড়িয়েছে। শুনানি শেষ। দম্পতির কিশোরী কন্যাকে ডাকলেন বিচারক। বাইরে অপেক্ষমান বিচ্ছেদের রায়-প্রত্যাশী দম্পতির প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলো যেন আর কাটে না। ভেতরে বিচারক কন্যাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তার কিছু বলার আছে কি না। কন্যাটির উত্তর—‘আমাকে কি বলতেই হবে?

ছবিটির এখানেই সমাপ্তি। কিন্তু দর্শকের কানে সিনেমার শেষ মুহূর্তটির শেষ সংলাপ ‘আমাকে কি বলতেই হবে?’ একটি দম আটকে দেওয়া অনুভুতির জন্ম দিতে পারে। কারণ, কিশোরীটির একটি উত্তরের পেছনে অসংখ্য উত্তর আছে। ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘জানি না’, ‘আমার কিছু আসে যায় না’, ‘তাদের সম্পর্ক তারাই বুঝবে’, ‘আমি কী করতে পারি? আমার দায় কেন হবে, ‘আমার কারণেই তাঁরা অসুস্থ সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন, এ রকম খোঁটা এবং দায় আমি নিতে যাব কেন’, ‘তাঁরা নিজেদের সম্পর্কের দেখভালেই ব্যর্থ, আমার দেখভালে সফল কীভাবে হবেন?’—এ রকম অসংখ্য সম্ভাব্য উত্তরও হতে পারে।

বিবাহ জীবনের জন্য নানাভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে নারী-পুরুষ একত্রে বৈধভাবে স্বামী-স্ত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন। সবাই চায় বিবাহিত জীবন সুখের হোক, দুজন মিলে স্বাচ্ছ্যন্দে জীবন কাটাতে সফল হোক।
বিধিবাম হলে বিবাহের পর নারী-পুরুষ যেমন সংসার শুরু করে, তেমনি অনেক সময় দেখা যায় বিচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি বেজে গেছে।

কেন বিচ্ছেদ, কেনইবা সংসার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না?

আইনজীবী জাহানারা পারভীন-এর  দীর্ঘ ২৫ বছর আইনীসেবা দিতে গিয়ে তার দেখা কিছু কারণ তুলে ধরেন অভিজ্ঞতার আলোকে- তার মতে,

আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ধৈর্যহীনতা, সহনশীলতার ঘটতি, ভার্চ্যুয়াল জগতের প্রভাবে বহুকামীতাই পারিবারিক সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে উঠার অন্যতম কারণের একটি।

তালাকের মূল কারণ ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন হলে নিন্মের কারণ গুলো শতকরা ৯৮%।

তার মতে তালাকের প্রধান তিনটা কারণ:

★ শারীরিক অক্ষমতা

★ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, পর্ণগ্রাফি, পরকীয়া, বহুকামীতা

★ মাদকাসক্তি / ড্রাপ এবইউজ ( প্রয়োজনের ব্যতীরেকে অথবা মাত্রাতিরিক্ত ঔষধ সেবক)

এছাড়াও…..

স্বামী বা স্ত্রী dominating character এর হলে

পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ ও একে অন্যের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকা

সবচেয়ে মূল সমস্যা টাকাপয়সা নিয়ে। স্ত্রীরা চাকুরী করলে টাকা পয়সার হিসেবে স্বামী চাইতে পারবে না কিন্তু স্বামীর টাকা পয়সার হিসেবে স্ত্রী আনায় আনায় হিসেবে নেয়।

স্বামী বা স্ত্রীর আত্নীয় স্বজন যখন স্বামী স্ত্রীর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন তখন ফলাফল একটা (ডিভোর্স) করেই ছাড়েন।

শারীরিক অক্ষমতা

শারীরিক অক্ষমতা, যৌনব্যাধি আর যৌনবিকারগ্রস্ত সঙ্গী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ। এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়। বিবাহ-বন্ধনের অন্যতম বিষয় হলো- স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য মিলন। প্রকারান্তরে সন্তান গ্রহণ। সমাজে প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত বাবা-মা তাদের সন্তান যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অক্ষম জানা সত্ত্বেও সন্তানকে বিবাহের আসরে বসিয়ে দেন। বাসর রাতেই অক্ষম স্বামীর হিংস্রতার শিকার হয় মেয়েটি। কখনও পরিবারকে এই লজ্জাজনক কথাটি জানাতে বাধ্য হয়, কখনওবা গোপনে চিকিৎসা চালিয়ে ব্যর্থ চেষ্টা করে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়।

যৌতুক

যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে বর বা কনে যেকোনো পক্ষের কাছে যৌতুক দাবি অপরাধ হিসেবে গণ্য। যৌতুকের জন্য স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় নারী। কখনও যৌতুকের বলি হয়ে মৃত্যুবরণও করার দৃষ্টান্ত সমাজে কম নয়। যৌতুক দাবি কিংবা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে।

বাল্যবিবাহ
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছরের কম বয়সের বিবাহকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। সম্প্রতি করোনাকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ভয়াবহ হারে। স্কুল বন্ধ, বাবা-মা ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েকে বিবাহ দিয়েছে অনেকটা ঝঞ্ঝামুক্ত হওয়ার জন্য। ছোট ছেলেমেয়েরা অনেকে নিজে পছন্দ করে পালিয়ে গিয়েও বিবাহ করে ফেলে। নাবালিকা কন্যা বিবাহের পর তার লালিত স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যখন মিল খুঁজে পায় না, যখন তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভেঙে যায়; তখনই বেছে নেয় বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত।

বহুবিবাহ
একজন নারী তার স্বামীকে একা পেতে চায়। স্বামীর ভাগ কোনোভাবেই কাউকে দিতে চায় না। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী গোপনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। সংসারের প্রতি স্বামীর দায়িত্বহীনতা আর উদাসীনতা নারীটিকে কাঁদায়। সংসার-সন্তান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় স্বামীর বহুবিবাহ মেনে নেয়া অনেক স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে নেয় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।

পরকীয়া

বর্তমানে যুগের একটি খারাপ দিক হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্পর্ক-স্থাপন। ফেসবুক-ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার-হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় সবাই অতি সহজেই পেয়ে যাচ্ছে নতুন সঙ্গী। ফলে পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে অনেক নারী-পুরুষ। গড়ে তুলছে এক্সট্রা-ম্যারিটাল সম্পর্ক। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। অন্যপুরুষ বা নারীতে আসক্ত পরিবারে অশান্তি-অবিশ্বাস ও নির্যাতন নিত্যদিনের ঘটনা৷ একসময় উভয়পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

মাদকাসক্তি
যার স্বামী-সন্তান, স্ত্রী বা পরিজন মাদকাসক্ত সে জানে মাদকের ভয়াবহতা। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আসা অধিকাংশের কাছ থেকে জানা যায়, মাদকাসক্ত কোনো ব্যক্তি আর মানুষ থাকে না। অমানুষে পরিণত হয়। নারী বা পুরুষ হয়ে যায় হিংস্র। শারীরিক-মানসিক নির্যাতনে প্রকট হয়ে ওঠে দাম্পত্য জীবনে।
দেশের প্রচলিত আইনে শারীরিক নির্যাতন অপরাধ। এর শাস্তির বিধান আছে কিন্তু মানসিক নির্যাতনের কোনো শাস্তি নেই। সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেলে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় ক্ষতিগ্রস্ত নারী। এছাড়া স্বনির্ভর ও আত্মসচেতন নারীরা এখন আর বাইরে কাজ করে এসে পারিবারিক নির্যাতন বা সহিংসতা মেনে নেয় না। ফলে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

বিপথগামী স্বামী-স্ত্রী ও বহুগামিতা

স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে সন্দেহ করা একটি মানসিক ব্যাধি। সন্দেহ যখন বাস্তবতায় রূপ নেয়, তখন অসুস্থ আবহাওয়ায় না থেকে বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। বহুগামী নারী-পুরুষ আর মানুষের চরিত্র ধারণ করতে পারে না। সুতরাং পঙ্কিলতা থেকে বেরিয়ে বিবাহবিচ্ছেদকে সঠিক পথ ভেবে বিচ্ছেদ বেছে নেয় ভুক্তভোগী।

অনধিকারচর্চার প্রবেশ

অনেক পরিবারে দেখা যায় বিবাহের পর পরিবারের অনেকে দম্পতির ব্যাপারে অনধিকারচর্চা করে। আত্মীয়স্বজন বা মুরব্বিদের কেউ কেউ নিজেদের মতো দম্পতির সংসার নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এতে একসময় তিক্ততা চলে আসে, যা বিবাহবিচ্ছেদের পথ খুলে দিতে পারে।

ধৈর্যহীনতা

আধুনিক যুগের ছেলেমেয়েরা একেবারেই ধৈর্যহীন। সামান্য বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তারা সংসার নির্বাহ করতে চায় না। হুট করে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সব কিছুতে থোড়াই কেয়ার। সহ্য করার ক্ষমতা নেই বলে সামান্য কারণে ছেলেমেয়েরা বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়। বিবেক, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না।

বর্তমানে সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে। প্রতিদিনই বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন পড়ে। এ সংবাদ পরিবার-সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য সুখকর হতে পারে না।
অনেকেই আইনবিধি ও নিয়মকানুনের ধারেকাছে না গিয়ে নোটিশ গোপন করে ৯০ দিন পর বিচ্ছেদের ঘোষণা দিচ্ছে। স্বামী বা স্ত্রী বিদেশে অবস্থান করছে; বিদেশে তালাক ঘটানো ব্যয়বহুল তাই দেখা যায়, এক ফাঁকে দেশে এসে গোপনে তালাক দিয়ে একজন আরেকজনকে প্রতারিত করছে। অনেকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে এমনকি নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে বে-আইনি ও নিয়মবহির্ভূতভাবে তালাক প্রদান করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাক দুটোরই ডিজিটালাইজেশন জরুরি। বিবাহ হলে অনলাইন যেমন জানতে পারবে, বিচ্ছেদ হলেও অনলাইনে বিষয়টি অবহিত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে বিবাহ রেজিস্ট্রেশন আর তালাক রেজিস্ট্রেশন অনলাইন হওয়া সময়ের দাবি। এতে করে প্রতারিত হওয়ার মাত্রা কমে যাবে। যা নারী-পুরুষ দুপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর।

তবে দিন দিন কেন এত বিবাহবিচ্ছেদ? তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিকতার পতন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপের পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জায়গা আজ ঠুনকো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।

ড. ফাতেমা রেজিনা ইকবালের মতে, বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে চলার অন্যতম কারণ হচ্ছে, ‘সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগরজীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া ইত্যাদি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’

মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়াই একমাত্র কৌশল, একেই বলে পারষ্পরিক সৌহার্দ্য শ্রদ্ধাবোধ। যার প্রবণতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষমার সদিচ্ছা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় চোখধাঁধানো কৃত্রিম সম্পর্ক দেখে নিজের বাস্তব জীবনে তা খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাও বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল ধরার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
সব মুদ্রারই যেমন দু’টি পিঠ আছে, তেমনি সব জিনিসেরই ভাল-খারাপ দু’টি দিক আছে। কিছু মানুষ অনেক সময় তালাকের অপব্যবহার করে। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে কি ধরনের অপরাধে তালাক দেওয়া যায় এবং তার পদ্ধতিগত ধাপগুলি ঠিকঠাক মানা হলো কি-না সেটা চিন্তা ভাবনা করে না। সর্বোপরি দেখা দরকার পারস্পরিক সংশোধন ও সম্পর্কের পুনর্জাগরণের সুযোগ দেওয়া হলো কি-না। এসব কিছু না ভেবে নিছক হঠকারিতা কিংবা বহুবিবাহের লিপ্সা থেকে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে বিবাহবিচ্ছেদের সহজলভ্য ছাড়পত্র বানানো কোন ধর্মই সমর্থন করে না।উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে এবং সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।